News update
  • Fire breaks out at jacket factory in Chattogram     |     
  • Dhaka, Delhi agree to bring down border killings to zero     |     
  • Natore’s Baraigram OC closed over negligence in bus robbery case     |     
  • Imported fruit prices surge by up to Tk 100 per kg     |     
  • 35% of air pollution in BD originates from external sources: Experts     |     

বরেন্দ্র এলাকায় পানির হাহাকার: মাটির নিচের পানি কোথায় গেলো?

গ্রীণওয়াচ ডেস্ক জলবায়ু 2024-06-24, 7:24pm

jgewuryew8ru-67403ad38321cdf35b8338d9965cb3521719235494.jpg




মাত্র চল্লিশ বছর আগেও যে এলাকায় পানি ছিলো সহজলভ্য এখন তার অনেক স্থানেই পানির সংকট। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত: নিচে নামতে থাকায় বিভিন্ন স্থানে অকেজো হয়ে পড়েছে সরকারি ডিপ টিউবওয়েল। এমন অবস্থা বাংলাদেশের উত্তরের ৫টি জেলার বিভিন্ন অংশ নিয়ে গঠিত বরেন্দ্র এলাকায়।

সরকারের গবেষণা বলছে, বরেন্দ্রর ৪০ শতাংশ এলাকা রয়েছে উচ্চ পানির সংকটে।

কৃষিতে ব্যাপকভাবে মাটির নিচের পানি উত্তোলন আর সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টি কমে যাওয়া -দুটো মিলিয়েই এই সংকট বলছেন গবেষকরা।

কিন্তু এমন অবস্থা কীভাবে তৈরি হলো?

রাজশাহীর তানোরে ছোট্ট একটি গ্রাম। নাম কামারপাড়া। সেখানেই একটি ডিপ টিউবওয়েলের সামনে কিছু মানুষের জটলা। তারা সকলেই এসেছেন পানি নিতে।

জটলার মধ্যে অবশ্য কোন পুরুষ নেই। সকলেই নারী। আছে কয়েকজন শিশুও।

সেখানেই দেখা হয় আদিবাসি নারী জাস্টিনা হেমব্রমের সঙ্গে। কোমরে বাধা মেডিকেল বেল্ট।

জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, বছরখানেক আগে পানি বহন করতে গিয়ে মাটিতে পড়ে যান। আঘাত পান কোমরে। এরপরই চিকিৎসকের পরামর্শে কোমরে বেল্ট পরেন তিনি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সিরিয়াল মেনে পানি সংগ্রহের পালা আসে জাস্টিনার। মাথায় পাতিল আর হাতের কলসে পানি নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা ধরেন তিনি।

তার পেছনে সঙ্গি হলেন পাড়ার অন্য বাসিন্দারাও। যাদের এই পানি সংগ্রহের যুদ্ধ চলে প্রতিদিন। রোদ-বৃষ্টি কিংবা ঝড়, মুক্তি নেই কোন কিছুতেই। এমনকি বাড়ির শিশুরাও অংশ নেন পানি সংগ্রহে।

“আমার কোমরে ব্যাথ্যা কিন্তু করার কিছু নেই। বাসা এক কিলোমিটার দূরে। বাঁচতে হলে আমাদেরকে এভাবেই পানি নিয়ে যেতে হবে প্রতিদিন।” বলছিলেন জাস্টিনা হেমব্রম।

তার ভাষায়, বাড়িতে পুরুষ মানুষ থাকলেও তারা খুব সকালেই কাজে চলে যান।

“পুরুষ লোকরা যদি পানি আনতে যায়, তাহলে তাদের কাজে দেরি হবে। তখন কাজ পাবে না। এজন্য তারা খুব সকালেই কাজে যায়। আমরা পরে পানি আনতে যাই।”

জাস্টিনা হেমব্রম থাকেন তানোরের মাহলপাড়ায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায় পাশাপাশি খোলামেলা পরিবেশে কয়েকটি ঘর। যেগুলোতে আলাদা আলাদা পরিবার বাস করে।

একটি টিউবওয়েল থাকলেও সেটায় পানি ওঠে না বহুদিন।

ফলে এখানকার সকলেই খাবার পানি আনেন দূরের ডিপ টিউবওয়েল থেকে।

সেটা দিয়েই চলে রান্না, গোসল, খাওয়া থেকে শুরু করে শুরু করে সংসারের সকল কাজ।

‘শান্তিমতো গোসল করতে পারিনা’ পানির সংকট নিয়ে জানতে চাইতেই রুবিনা বেগম নামে একজন বলছিলেন গলায় তীব্র ক্ষোভ নিয়ে।

“গেলো বর্ষার সময় দূরের একটা পুকুরে গিয়ে গোসল করেছিলাম। ওটাই শেষ। বর্ষার পরে পুকুরের পানি কমে যায়, নোংরা হয়ে যায়। পুকুরের পানি দিয়ে ধানক্ষেতে সেচ দেয়। পানি থাকে না। তাই গোসলও করা যায় না। এখন আধা বালতি পানি দিয়ে কোনরকম গোসল হয়।”

“ডিপ টিউবওয়েল থেকে চার বালতি পানি আনি প্রতিদিন। এই পানি দিয়েই পরিবারের তিনজনের গোসল, রান্না, খাওয়া সব সারতে হয়। আর কাপড় এবং থালা-বাসন ধুতে হয় পুকুরের নোংরা পানিতে।”

পাশের ঘরেই বারান্দার সামনে চার বছরের ছোট্ট ছেলের শরীর ভেজা কাপড়ে মুছে দিচ্ছিলেন আরিফা খাতুন। জানালেন, গরমে কষ্ট পেলেও ছেলেকে প্রতিদিন গোসল করাতে পারেন না। পানি দিয়ে কাপড় ভিজিয়ে শরীর মুছে দেন।

“আমি নিজেই টাইফয়েড থেকে সেরে উঠলাম। ডাক্তার বলছে, শরীরে পানি কম আছে। এখন বাচ্চাটারও ঠিকমতো যত্ন নিতে পারি না। গরমে বাসায় যে ভালোভাবে গোসল করাবো সেই পানিটা নেই। আরো দুটো বাচ্চা স্কুলে যায়। তাদেরকেও অনেক সময় পানি না থাকায় সকালের নাস্তা খাওয়াতে পারি না। না খেয়েই স্কুলে যায়,” বলছিলেন আরিফা খাতুন।

‘পানির অভাবে ধান মরে গেলো, পানি পেলাম না’

বরেন্দ্র এলাকায় কৃষকদের বিশেষত: শুষ্ক মওসুমের বোরো ধানের জন্য নির্ভর করতে হয় সরকারি সংস্থা বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ডিপ টিউবওয়েলের উপর।

এর বাইরে ব্যক্তিগত পর্যায়ের ডিপ টিউবওয়েল থেকেও পানি নিতে পারেন কৃষকরা।

কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই পানি নিতে বিঘাপ্রতি ৬ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ হয় কৃষকদের।

আবার চাহিদা বেশি হওয়ায় কোন কোন এলাকায় শেষ পর্যন্ত পানি পান না এমন কৃষকও আছে।

তাদেরই একজন তানোরের দবিরুল ইসলাম। জানালেন, চার বিঘা জমির দুই বিঘা আবাদ করেছেন, আর বাকি দুই বিঘা আবাদ করতে পারছেন না। কারণ পানি নেই।

“পানি নাই, আবাদও করতে পারি নাই। ঘুরলাম পানির জন্য। ডিপ টিউবওয়েলের অপারেটর বললো আজকে দিবো, কালকে দিবো, চারদিন পরে দিবো। এমন করতে করতেই পানির অভাবে ধান মরে গেলো, পানি পেলাম না। পরে ধান যা বেঁচে ছিলো কেটে ফেলেছি।”

দবিরুল ইসলামের মতোই এবছর ধান চাষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুন্ডুমালার আরেক চাষী মাইকেল।

তিনি জানাচ্ছেন, এবার তার কয়েকবিঘা জমিতে ধান লাগানোর পর সেচের জন্য পর্যাপ্ত পানি পাননি। কারণ ডিপ টিউবওয়েল থেকে চাহিদামতো পানি ওঠেনি।

অন্যদিকে যখন পানির দরকার তখন বৃষ্টিও হয়নি। ফলে ক্ষতির মুখে পড়েছে তার ফসল।

“পানির স্তর অনেক নেমে গেছে। শুরুতে পানি পাচ্ছিলাম। কিন্তু পরে ডিপ থেকে আর পানি উঠছিলো না। ফলে পানি দিতে পারি নাই। ধানে তখন পোকা ধরলো। অনেক ধান চিটা হয়ে গেছে। বিঘায় মনে করেন পাঁচ মনের বেশি ধান কম পাবো এবার,” বলছিলেন মাইকেল।

মাটির নিচের পানি কোথায় গেলো?

রাজশাহীর তানোরে কৃষকসহ সকলেই বলছেন এখানে যে পানির তীব্র সংকট তার মূল কারণ মাটির নিচে যথেষ্ট পানি পাওয়া যাচ্ছে না।

কিন্তু এখানে পানি আসলে মাটির কতটা গভীরে?

তানোরের উঁচাডাঙ্গা গ্রাম। এখানে মাটির নিচে পানির স্তরের গভীরতা মাপার জন্য ডিপ টিউবওয়েলের পাইপ বসিয়েছে বেসরকারি একটি এনজিও।

সেখানে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে পানির গভীরতা মাপেন সাইমন মারান্ডি।

গেলো ২০শে এপ্রিল সেখানে গিয়ে দেখা যায় ঐদিন পানির নিম্নস্তর পাওয়া গেছে ১১৬ ফুট নিচে।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে পানির স্তর ছিলো ১০৬ ফুট গভীরে।

অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছরে পানির স্তর নেমেছে ১০ ফুট।

সাইমন মারান্ডি বিবিসি বাংলাকে বলেন, তার পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে যে প্রতিবছরই ধারাবাহিকভাবে পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাচ্ছে।

“বর্ষা মওসুমে মাটির নিচে পানির অবস্থা একটু উন্নতি হয়। বর্ষায় হয়তো পনেরো সেন্টিমিটার উন্নতি হয়ে গেলো, শুকনো মওসুমে আবার সেটি নামা শুরু করলো। নামতে নামতে পরের বৈশাখে দেখা যায় পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ সেন্টিমিটার নিচের দিকে চলে যায়। পানি এখানে নিচের দিকে নেমে যাওয়ার হারটাই বেশি।”

রাজশাহীতে পানির সংকট বেশি দেখা যায় মূলত: বরেন্দ্রর উচু এলাকাগুলোয়। রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁসহ পাঁচটি জেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত বরেন্দ্র এলাকায় পানি সংকট তীব্র হয়েছে গেলো দুই দশকে।

সর্বশেষ সরকারের পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা ওয়ারপোর জরিপে দেখা যায় বরেন্দ্রর ২১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮৭টি ইউনিয়নই উচ্চ পানির সংকটে রয়েছে।

এমনকি ১৯৯০ এর দশকের তুলনায় এখনকার সময়ে পানিসংকটাপন্ন এলাকার সংখ্যাও বেড়েছে।

এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের গবেষণাতেও বরেন্দ্র এলাকায় পানির গড় নিম্নস্তর নামতে দেখা গেছে। বিভাগের গবেষণা অনুযায়ী, বরেন্দ্র এলাকায় ১৯৯৪ সালে মাটির নিচে পানির গড় নিম্নস্তর ছিলো ৩৫ ফিট।

সেটা ২০০৪ সালে ৫১ ফিটে নেমে আসে।

২০১৩ সালে পানির গড় নিম্নস্তর পাওয়া যায় ৬০ ফিট নিচে।

২০২১ সালে এসেও দেখা যাচ্ছে পানির গড় স্তর ৭০ ফিটের নিচে পাওয়া যাচ্ছে।

তবে কোন কোন এলাকায় পরিস্থিতি আরো খারাপ। সেগুলোতে প্রায় দুইশত ফিট নিচেও পানির স্তর পাওয়া যাচ্ছে না।

ফলে অনেক স্থানেই সরকারের বসানো ডিপ টিউবওয়েল পানির নাগাল না পেয়ে এখন বিকল অবস্থায়।

এরকমই একটি গ্রাম আছে বাধাইর ইউনিয়নে। সেখানে বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের বসানো একটি গভীর নলকূপ কয়েকবছর ধরেই বিকল।

নলকূপ ঘরের তালা খুলে দেখা যায় সেখান থেকে ডিপটিউবওয়েলের যন্ত্রপাতি তুলে ফেলা হয়েছে।

বিকল অবস্থায় পড়ে আছে পানির ত্রিমুখী তিনটি লাইন, সুপেয় পানির রিজার্ভার ইত্যাদি।

এখানকার অপারেটর মুস্তাফিজুর রহমান জানালেন, নলকূপের গভীরতা ছিলো ১১০ ফিট। কিন্তু পানি না পাওয়ায় নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ে।

রাজশাহীর তানোরে মাটির নিচে পানির গভীরতা মেপে দেখছেন সাইমন মারান্ডি 

পানির সংকট কীভাবে তৈরি হলো?

বরেন্দ্র এলাকায় সামগ্রিকভাবেই ৪০ বছর আগে খুব সহজেই পানি পাওয়া যেতো। কিন্তু এখন সেটা কেন পাওয়া যাচ্ছে না? এর উত্তরে কয়েকটি কারণ বের হয়ে আসছে।

এক. বরেন্দ্র এলাকায় নব্বইয়ের দশকের আগেও মূলত: একটি ফসলের চাষ হতো। সেটা হলো আমন ধান। কিন্তু নব্বই দশক থেকে ব্যাপকভাবে তিন ফসলের চাষ শুরু হয়। এই চাষাবাদের পুরোটাই আবার বলা যায় ভূগর্ভস্থ পানি নির্ভর। বোরো চাষে পানির প্রয়োজন আরও বেশি হয়। সবমিলিয়ে চাষাবাদের জন্য ব্যাপকভাবে পানি উত্তোলন শুরু হয়।

দুই. বরেন্দ্র এলাকার গবেষকরা বলছেন, দেশের অন্যান্য এলাকার গড় বৃষ্টিপাতের তুলনায় বরেন্দ্র এলাকায় বৃষ্টিপাত কম হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তরে তথ্য নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান একটি গবেষণা করেছেন।

সেই গবেষণায় তিনি তথ্য দিচ্ছেন, আশি এবং নব্বই দশকের তুলনায় এর পরের দুই দশকে বরেন্দ্রর পানি সংকটে থাকা এলাকাগুলোতে গড় বৃষ্টিপাত কমে গেছে ৪০০ মিলিমিটার। একদিকে পানির উত্তোলন বেড়েছে অন্যদিকে বৃষ্টি কম হওয়ায় মাটির নিচে পানির পূনর্ভরণ হয়নি। ফলে পানির স্তর আরো নিচে নেমেছে।

তিন. আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, বরেন্দ্র এলাকার মাটি উঁচু। অন্যদিকে একে ঘিরে থাকা নদীগুলো তুলনামূলক নিচে। ফলে মাটিতে বৃষ্টির পানি নিচে নামলেও সেটা ভূ-অভ্যন্তরভাগ দিয়েই দ্রুত গড়িয়ে নদীর নিচে চলে যায়। এছাড়া নদী-নালা-খাল শুকিয়ে যাওয়ায় সেগুলোতেও পানি জমে থাকে না।

“এখানে আসলে পানি নির্ভরতা বেশি। এখানে শুকনো মওসুমও অনেক লম্বা। কৃষিকে বাঁচাতে মাটির নিচের পানিই ব্যবহার হয়। এখানে পানির আধার তো আনলিমিটেড না। ফলে বিশ বছর আগেও যে অবস্থা ছিলো, এখন সে অবস্থা নেই। এখন সব ফ্যাক্টর যোগ হয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। এটা চলতে থাকলে কোথাও কোথাও অচিরেই পানিশূন্য অবস্থা তৈরি হবে,” বলছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বরেন্দ্র গবেষক চৌধুরী সারওয়ার জাহান।

তার মতে, এই এলাকায় প্রচুর গাছপালা রোপন করতে হবে, যেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করা যায়। একইসঙ্গে নদী-নালা-খাল বিলের গভীরতা বাড়াতে হবে। পুকুর, খালের সংখ্যা বাড়াতে হবে। যেন বৃষ্টির পানি দীর্ঘদিন জমা থাকে এবং সেটা কৃষির কাজে ব্যবহার করা যায়।

সমাধান কোথায়?

বরেন্দ্র এলাকায় পানিসংকট মোকাবেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ‘বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ বা বিএমডিএ।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন এই সংস্থাটি নীতি কৌশল ঠিক করা ও প্রয়োগে ভূমিকা রাখার কথা।

কিন্তু পানি সংকট নিরসনে সংস্থাটি কী করছে?

এক্ষেত্রে বরেন্দ্র এলাকায় খোঁজ নিয়ে মোটাদাগে দুটি বিষয় দেখা যাচ্ছে।

এক. ২০১৫ সালের পর থেকে বরেন্দ্র এলাকায় সরকারিভাবে ডিপটিউবওয়েল বসানোর কার্যক্রম বন্ধ রেখছে বিএমডিএ। উদ্দেশ্য মাটির নিচের পানি যেন কম ব্যবহার হয়।

দুই. একইসঙ্গে পদ্মা, মহানন্দা, করতোয়াসহ বিভিন্ন নদী থেকে পানি এনে রাবার ড্যামে আটকে কৃষিতে সেচের ব্যবস্থা করেছে সংস্থাটি।

কিন্তু এরপরও বরেন্দ্র এলাকায় কৃষিতে পানির যে চাহিদা সেটা পূরণ হচ্ছে মাত্র ১৩ শতাংশ।

অর্থাৎ বাকি ৮৭ শতাংশ পানি এখনও মাটির নিচ থেকেই উত্তোলন করা হচ্ছে।

প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে প্রতিদিন খাবার পানি সংগ্রহ করেন রাজশাহীর তানোরের বাসিন্দা জাস্টিনা হেমব্রম 

জানতে চাইলে বিএমডিএ’র ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুর রশীদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, তারা ধাপে ধাপে ভূগর্ভস্থ পানির নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছেন।

“আমাদের ২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা আছে যে, আমরা সারফেস ওয়াটার অর্থাৎ মাটির উপরের পানির ব্যাবহার ৩০ শতাংশে নিয়ে আসবো। তখনও ভূগর্ভস্থ পানিতে নির্ভরতা থাকবে ৭০ শতাংশ। কেননা এই শতভাগ পানির চাহিদা সারফেস ওয়াটারে মেটানো সম্ভব না যেহেতু এর উৎস নেই। অর্থাৎ এখানে পানির সোর্স এভেইলেবল না। শতরাং আমরা এখানে একটা যৌথ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করছি। গ্রাউন্ড ওয়াটারও থাকবে, সারফেস ওয়াটারও থাকবে।”

কিন্তু এখন মাটির উপরে যে পানি পাওয়া যাচ্ছে সেটা কোথা থেকে আসছে এমন প্রশ্নে মি. রশিদ জানান, এই পানি আনা হচ্ছে বিভিন্ন নদী থেকে।

“পদ্মা, মহানন্দা, করতোয়া থেকে পাইপ দিয়ে পানি আনা হচ্ছে। এছাড়া দিনাজপুরের আত্রাই নদীর পানি আনাসহ এরকম কয়েকটি প্রকল্প নিয়ে এখন কাজ হচ্ছে। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, মাটির নিচের পানির উপর চাপ কমানো। এছাড়া এখানে ধান আবাদে অনেক পানি দরকার হয়।''

''সেখানে যদি ধানের পরিবর্তে কম পানি লাগে এমন ফসল যেমন মাল্টা, ড্রাগন, আমগাছ, সরিষা, তিল ইত্যাদির চাষ বাড়ানো যায় তাহলেও কৃষিতে পানির ব্যবহার কমে আসবে। এই সবকিছুর মাধ্যমেই আমরা সমন্বিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতের চাই।”

পানির সংকটে বরেন্দ্র এলাকায় অবশ্য ইতোমধ্যেই কৃষকদের অনেকে বিকল্প কৃষিতে ঝুঁকেছেন। এটা একটা বড় পরিবর্তন।

আগে ধান চাষ হতো এমন জমিতে এখন আম, মাল্টা, ড্রাগনের বাগান যেমন গড়ে উঠছে, তেমনি সরিষা, তিলসহ ভুট্টা চাষেও আগ্রহী হচ্ছেন কৃষক। যেগুলোতে পানির ব্যবহার কম।

এছাড়া কম পানির সেচে বোরো ধান চাষের প্রযুক্তিও কাজে লাগাচ্ছেন অনেকে।

যদিও বাস্তবতা হচ্ছে, এসবের ব্যপকতা কম। ফলে এখানকার কৃষি এখনও মাটির নিচের পানি নির্ভর।

সবমিলিয়ে একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাত কমছে, অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির নির্ভরতাও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমানো যায়নি।

ফলে জাস্টিনা হেমব্রমের মতো মানুষ -যারা পানির সংকটে আছেন তাদের নিত্যদিনের সংকটও অব্যাহত থাকছে। বিবিসি বাংলা