News update
  • It’s official: January was the warmest on record     |     
  • OIC Condemns Trump's Statement on Displacing Palestinians from Gaza      |     
  • Turnout in Boi Mela increasing, key focus on July uprising     |     
  • Bangladesh Summons Indian Envoy Over Hasina’s Remarks     |     
  • 14 individuals, women's football team to get Ekushey Padak     |     

সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে ব্যাংক রক্ষার পদক্ষেপ নিতে হলো কেন?

বিবিসি বাংলা ব্যাঙ্কিং 2024-12-01, 7:58am

img_20241201_075845-14de63f6fbfa280f84ad3683d3c52a6d1733018438.png




অতীতের মতো টাকা ছাপিয়ে সরকারকে বা কোনও ব্যাংককে অর্থ দেয়া হবে না- গত অগাস্টেই এমন মন্তব্য করেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। কিন্তু মাত্র তিন মাসের মধ্যেই এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে ছয়টি দুর্বল ব্যাংককে দেয়ার কথা জানিয়েছেন খোদ গভর্নরই। একইসঙ্গে রোববার থেকে এসব ব্যাংকের গ্রাহকরা টাকা তুলতে পারবেন বলেও জানান তিনি।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর এসব কথা বলেন।

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, টাকা না ছাপানোর সিদ্ধান্ত থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কেন সরে আসতে হলো? আর এর প্রভাবই বা কী হতে পারে? তাছাড়া টাকা ছাপিয়ে ব্যাংক রক্ষা করার পদক্ষেপই বা কতটা ফলপ্রসূ হবে?

বর্তমান পরিস্থিতিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য “উভয় সংকট” বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। একদিকে যেমন দুর্বল ব্যাংকের গ্রাহকদের অর্থের নিরাপত্তা দিতে হবে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতিকেও সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে।

সেক্ষেত্রে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে 'খুব বেশি বিকল্প ছিল না' বলেও মত তাদের। এদিকে টাকা ছাপানোকে ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও’ বলছেন কেউ কেউ।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, একদিকে যেমন টাকা ছাপানো হচ্ছে, তেমনি সেই টাকা বাজার থেকে তুলেও নেয়া হবে। ফলে ‘মূল্যস্ফীতিকে ঠিক রাখার প্রচেষ্টা থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন না’ বলেও জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর।

“টাকা ছাপানো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত”

সংকটে থাকা ন্যাশনাল, এক্সিম, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন- এই ছয় ব্যাংককে তারল্য সহায়তা হিসেবে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

“এসব ব্যাংকের আমানতকারীরা যেন তাদের টাকা ফেরত পান, সেই চিন্তা থেকেই টাকা না ছাপানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই সহায়তা দিচ্ছে”, বলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।

তিনি আরও বলেন, “ইতোমধ্যে ২২ হাজার কোটি টাকার ওপরে আমরা দিয়েছি। আমরা মনে করি যে এটাই যথেষ্ট হবে। প্রয়োজনে আরও দেয়া যাবে, কোনো অসুবিধা নাই”।

“গ্রাহকদের বলবো আপনাদের টাকা নিরাপদ জায়গায় আছে, নিশ্চিন্তে থাকুন, এটা নিয়ে মাথাব্যথা আমাদের। আমরাই সলভ করবো”, বলেন গভর্নর।

তবে টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অর্থ দেয়ার সিদ্ধান্তটি ‘রাজনৈতিক’ বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ।

দেশের কিছু ব্যাংক কার্যত 'দেউলিয়া' হয়ে গেছে উল্লেখ করে বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “এরা আমানতকারীদের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। ব্যাংকে এসে চেক জমা দিয়েও টাকা পাচ্ছে না। এতে করে যে হতাশা তৈরি হয়েছে তা থেকে বিশৃঙ্খলাও সৃষ্টি হতে পারে”।

“এটা শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা হবে না, এটা একটা রাজনৈতিক সমস্যা হয়ে যাবে”, বলেন অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ।

“আমানতকারীদের প্রচণ্ড চাপের মুখে- অর্থনৈতিক না, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে টাকা ছাপানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে” বলেও মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।

এদিকে ‘আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষাকেই’ টাকা ছাপানোর প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।

তার মতে, দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকের গ্রাহকদের চাহিদা যদি আংশিকভাবেও পূরণ করা না যায় তাহলে “আতঙ্ক তৈরির শঙ্কা আছে, যা পুরো ব্যাংকিং খাতকে আক্রান্ত করতে পারে”।

এর আগে, গত সেপ্টেম্বরে একটি গ্যারান্টি স্কিম চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।এর আওতায়, তারল্য ঘাটতি মেটাতে সবল ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে স্বল্পমেয়াদে ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আর এই ঋণের গ্যারান্টার হয় খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

তবে এতে ‘হয়তো পর্যাপ্ত সাড়া পায়নি’ বলেই টাকা ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। আর তার কারণ হিসেবে আস্থার সংকটকেও দেখছেন কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ।

যেমন, কোনো দুর্বল ব্যাংক যদি ঋণ নেয়ার পর তা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকেও সেই অর্থ উদ্ধার করতে সবল ব্যাংকে বেশ অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।

সবমিলিয়ে যে অঙ্কের অর্থ সবল ব্যাংকগুলো দিয়েছে সেটা তাদের দুর্বল ব্যাংকের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না।

ফলে আমানতকারীদের মধ্যে তৈরি হওয়া আতঙ্ক ঠেকাতেই বাংলাদেশ ব্যাংককে টাকাটা দিতে হয়েছে বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন।

“মুদ্রাস্ফীতিতে ঘি ঢালা হবে”

বিগত সরকারের সময় ব্যাংক খাতের সংকট কাটাতে সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নিলেও তা কার্যকর করা যায়নি।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর নতুন নিযুক্ত গভর্নর মি. মনসুর একইসঙ্গে টাকা না ছাপানো এবং ব্যাংক দেউলিয়া হতে না দেয়ার কথা বলেন। কিন্তু ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়া ঠেকাতে তারল্য সংকটের সমাধান প্রয়োজন।

এমন প্রেক্ষাপটে যদি সবল ব্যাংক কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি দুর্বল ব্যাংককে টাকা না দেয় তাহলে ব্যাংকগুলো নিজেদের ‘দেউলিয়া’ ঘোষণা করতে বাধ্য হবে, বলছিলেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ।

“কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই এই সরকার চাইবে না। সেজন্য আমার ধারণা অবশেষে তাদের টাকা ছাপাতে হচ্ছে”, বলেন তিনি।

কিন্তু এটি করতে গিয়ে মূল্যস্ফীতি বাড়ার শঙ্কার কথাও বলছেন অর্থনীতিবিদরা।

“উদ্ধার পাওয়ার জন্য যেই ব্যাংকগুলোকে এই টাকাটা দেবে, তারা তাদের আমানতকারীদের দেবে। আর আমানতকারীরা নিশ্চয়ই সেটা খরচ করবে এবং মুদ্রাস্ফীতিতে ঘৃতাহুতি দেবে,” বলেন অধ্যাপক আকাশ।

অনেকটা একই কথা বলেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। টাকা ছাপানোর মাধ্যমে ‘মুদ্রাস্ফীতিতে ঘি ঢালা হবে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এনিয়ে অর্থনীতিবিদ মি. মাহবুব উল্লাহ বলেন, “সাময়িকভাবে হতাশা-বিশৃঙ্খলা থেকে উতরে গেলেও অর্থনীতির ওপর এটার ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে এবং মূল্যস্ফীতির সমস্যা আরও জটিল হয়ে যাবে”।

টাকা না ছাপিয়ে সমস্যা সমাধানের ‘খুব বেশি বিকল্প ছিল না’- এমনটাই বলছেন অর্থনীতিবদরা।

এদিকে মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা মাথায় রেখেই বাজারে বন্ড ইস্যু করার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এনিয়ে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আমরা টাকা ছাপাবো না বলেছিলাম, সেখান থেকে সাময়িকভাবে সরে আসছি, কিন্তু পুরোপুরিভাবে নয়”।

বন্ড ইস্যু করার মাধ্যমে ছাপানো টাকা বাজার থেকে উঠিয়ে নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

গভর্নর বলেন, “বন্ড ছাড়ার মূল কারণ হচ্ছে, আমরা একহাতে লিকুইডিটি সাপোর্ট দেবো, আরেক হাতে লিকুইডিটি উইথড্র করবো”।

এসময় বাজারের টাইট মনিটরিং পলিসি ধরে রাখা হবে বলেও জানান তিনি।

“সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক ভারসাম্যটা যেন থাকে, লিকুইডিটিটা ঠিক থাকে- আমাদের মূল্যস্ফীতিকে ঠিক রাখার জন্য আমাদের যে প্রচেষ্টা, সেটা থেকে আমরা কিন্তু পিছিয়ে যাচ্ছি না”।

এতে করে “গ্রাহকের অসুবিধা হবে না, বাজারকেও আমরা অস্স্থিতিশীল করবো না- সুন্দরভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করবো এবং করবোও” বলেন মি. মনসুর।

তবে বাজারে আসা টাকা সময়মতো বন্ডের মাধ্যমে সময়মতো ফিরিয়ে নেয়া না হলে “মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি থেকেই যাবে” বলে মনে করেন মি. হোসেন।

আর বন্ডের বিষয়ে খুব বেশি আশাবাদী নন মি. মাহবুব উল্লাহ।

“এটা ডিপেন্ড (নির্ভর) করে একটা দেশের অর্থনীতির অবস্থা কীরকম তার ওপর। বাংলাদেশে এখনো ফিন্যানশিয়াল মার্কেট ওভাবে ডেভেলপ করেনি। শেয়ার মার্কেটেও সাফল্য খুব একটা দেখিনি আমরা”।

“সমস্যা সমসাধানে বন্ড একটা ইন্সট্রুমেন্ট (উপাদান), কিন্তু এই ইন্সট্রুমেন্ট এই দেশে কতটা একসেপ্টেবল (গ্রহণযোগ্য), মানুষ কতটা এটা বোঝে- সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে”, বলেন তিনি।

“যারা এই ব্যাংকগুলো দেউলিয়া করার জন্য দায়ী তাদের সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে, তা বাইরে বিক্রি করে সেখান থেকে টাকা সংগ্রহ করে যদি সেই টাকা দিয়ে এই ব্যাংকগুলো উদ্ধার করা হতো, তাহলে বার্ডেনটা (চাপ) সাধারণ মানুষের ওপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আকারে পড়তো না”, বলেন অর্থনীতিবিদ মি. আকাশ।

ফলে সরকারের কাছে যে বিকল্প ছিল তা ‘আরও কঠিন’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

কেমন পদক্ষেপ হলো?

দুর্বল ব্যাংক রক্ষায় টাকা ছাপানোর বিষয়টিকে “উভয় সংকট” বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

“এটা যে খারাপ, সেটাতো বর্তমান ব্যাংকের গভর্নর নিজেই বলেছিলেন। কিন্তু তিনি এটা করতে বাধ্য হয়েছেন বলে আমার ধারণা”, বলেন মি. আকাশ।

একদিকে টাকা না ছাপালে ব্যাংকগুলোকে সাময়িকভাবে উদ্ধার করা যাচ্ছে না, আবার অন্যদিকে টাকা ছাপালে অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি আরও তীব্র আকার ধারণ করছে।

মি. হোসেন বলেন, “না ছাপালে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি কমে যাচ্ছে, কিন্তু আমানতকারীরা অশান্ত হয়ে যেতে পারে”।

একে “জলে কুমির, ডাঙায় বাঘের মতো অবস্থা, এটা উভয় সংকট”, বলেন অর্থনীতিবিদ মাহবুব উল্লাহ।

আর এখান থেকে উদ্ধার পাওয়াও সহজ ব্যাপার না বলে মত এই অর্থনীতিবিদের।

সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ব্যাংকগুলো এই সমস্যা থেকে উতরে আসতে পারবে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

একসঙ্গে যারা টাকা নিয়ে খেলাপি হয়েছে তাদের থেকে অর্থ আদায় করতে পারলেই ব্যাংকের তারল্য সংকট সমাধান হবে বলে মনে করছেন মি. মাহবুব উল্লাহ।