
রপুরের ঝিনাইগাতীতে গারো সম্প্রদায়ের বৃহৎ সামাজিক উৎসব ওয়ানগালা (নবান্ন) শুরু হয়েছে।
শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল ১১টার দিকে স্থানীয় মরিয়মনগর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত তিন দিনব্যাপী এ উৎসবের উদ্বোধন করেন ঢাকা মহা ধমপ্রদেশের কার্ডিনাল বিশপ প্যাট্রিক ডি. রোজারিও।
এসময় তিনি বলেন, জীবন শুধু বর্তমান নয়, জীবন অতীতের, জীবন বর্তমানের এবং ভবিষ্যতের। যখনি আমরা উৎসবে মিলিত হয়; তখন সেই উৎসবটা নদীর মহনা হিসেবে কাজ করে। সেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের কালপ্রবাহ মিলিত হয় এ মহনায়। উৎসব মিলনের মহনায়; আর সেই অনুভূতিতে মরিয়মনগর ধর্মপল্লী একত্রিত হচ্ছে-হবে আর আগামী তিনটি দিনের সমস্ত অনুষ্ঠান পালন করবে।
তিনি আরও বলেন, এই অনুষ্ঠান শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটা জীবনের উদ্যাপন। জীবনের যা কিছু আছে, যা কিছু ছিল তারই অভিব্যক্তি, তারই প্রকাশ, তারই উদ্যাপন। কাজেই বাহির থেকে আমদানি করা কোনো কিছু নেই এখানে। এখানে আমাদের জীবনের যা বিশেষত্ব, যা পরম্পরাগতভাবে আমরা পেয়েছি। আমাদের পূর্বে যারা চলে গেছেন এবং এখন যারা আছেন। সেটি উদ্যাপন করছি এবং সেটা উদ্যাপনের সাথে সাথে সঞ্চারিত করছি। অর্থাৎ ভবিষ্যতের প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের জীবনযাত্রা, জীবনপ্রণালি, জীবনপদ্ধতি। আরও অনুপ্রাণিত করছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যেন তারাও তাদের জীবনকে উদ্যাপন করে।
ঝিনাইগাতীর মরিয়মনগর ক্রিশ্চিয়ান মিশন এ উৎসবের আয়োজন করেছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মরিয়মনগর মিশনের পাল পুরোহিত ফাদার লরেন্স রিবেরু। এতে বক্তব্য দেন মরিয়মনগর ধর্শ পল্লীর প্যারিস কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অনার্শন চাম্বুগং।
জানা গেছে, গারোদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ‘ওয়ানগালা’। ‘ওয়ানা’ শব্দের অর্থ দেবদেবীর দানের দ্রব্যসামগ্রী আর ‘গালা’ অর্থ উৎসর্গ করা। দেবদেবীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ মনোবাসনার নানা নিবেদন হয় এ উৎসবে। সাধারণত বর্ষার শেষে ও শীতের আগে, নতুন ফসল তোলার পর এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। এর আগে নতুন খাদ্যশস্য ভোজন নিষেধ থাকে এ সম্প্রদায়ের জন্য। তাই অনেকেই একে নবান্ন বা ধন্যবাদের উৎসবও বলে থাকেন। আবার ওয়ানগালা উৎসব একশ ঢোলের উৎসব নামেও পরিচিত।
গারোদের বিশ্বাস,‘মিসি সালজং’ বা শস্য দেবতার ওপর নির্ভর করে ফসলের ভালো ফলন। নতুন ফল ও ফসল ঘরে উঠবে। তার আগে কৃতজ্ঞতা জানাতেই হবে। শস্য দেবতার প্রতি। তাই শস্য দেবতাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ও নতুন ফসল খাওয়ার অনুমতির জন্য নেচে-গেয়ে উদ্যাপন করা হয় ঐতিহ্যবাহী ওয়ানগালা উৎসব। একই সঙ্গে পরিবারে ভালোবাসা, আনন্দ ও সব পরিবারের মঙ্গল কামনা করা হয় শস্য দেবতার কাছে।
আয়োজক কমিটি সূত্রে জানা গেছে, এ বছর তিন দিনব্যাপী উৎসব উপলক্ষ্যে কিশোর-কিশোরীদেও চিত্রাঙ্কন, ছড়া (মান্দি ভাষায়), নৃত্য, মিস ওয়ানগালা প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা ও খেলাধুলার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া থাকছে বাণী পাঠ (মান্দিতে), খামালকে খুখুব ও থক্কা প্রদান, জনগণকে থক্কা দেওয়া, পবিত্র খ্রিস্টযাগ, দান সংগ্রহ, আলোচনাসভা, প্রার্থনা ও নকগাথা অনুষ্ঠান। এছাড়া এ উৎসব ঘিরে বিদ্যালয়ের মাঠে গড়ে ওঠা অস্থায়ী দোকানে ঐতিহ্যবাহী পোশাক, খাবার ও শিশুদের নানা রকমের খেলনা নিয়ে বসেছে মেলা।
ওয়ানগালা উৎসব কমিটির আহ্বায়ক মরিয়মনগর ধর্মপল্লীর পালপুরোহিত ফাদার ফাদার লরেন্স রিবেরু সিএসসি জানান, ১৯৮৫ সাল থেকে মরিয়মনগর সাধু জর্জের ধর্মপল্লীর উদ্যোগে ওয়ানগালা উৎসব পালন করা হচ্ছে। প্রাচীনকাল থেকে গারো সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্ম ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে তুলে ধরাই এর মূল লক্ষ্য। আগামী রোববার বিকেলে এ উৎসব শেষ হবে।