ইরানের উপকূল থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে পারস্য উপসাগরে অবস্থিত খার্গ আইল্যান্ডের টার্মিনাল থেকেই দেশটির তেলের ৯০ শতাংশ রফতানি হয়ে থাকে। ছবি: সংগৃহীত
ইসরাইলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর এই মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাতের সব মনোযোগের কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে পারস্য উপসাগরে অবস্থিত ২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রুক্ষ পাথুরে একটি দ্বীপ। খার্গ আইল্যান্ড নামের এই দ্বীপকে কেন্দ্র করে যে কোনো সময় নরকে পরিণত হতে পারে পুরো মধ্যপ্রাচ্য। এমনকি তা রূপ নিতে পারে সর্বনাশা যুদ্ধের, যা থেকে সূত্রপাত হতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও! পাশাপাশি ছোট্ট এই দ্বীপের ওপর নির্ভর করছে পুরো বিশ্বের জ্বালানি নিরাপত্তা, যার ওপর নির্ভর করছে বিশ্বের অর্থনীতির স্থিতিশীলতাও।
বিশ্বের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ খার্গ আইল্যান্ড?
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে ইরানের তেল অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলার হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল। আর ঠিক এ কারণেই হঠাৎ করেই আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে খার্গ আইল্যান্ডের নাম। পারস্য উপসাগরে অবস্থিত ছোট্ট এই দ্বীপকে বলা হয় ইরানের অর্থনীতির ‘প্রাণকেন্দ্র’। কারণ এই দ্বীপে অবস্থিত ‘অয়েল টার্মিনাল’ দিয়েই নিজেদের প্রায় সব তেল রফতানি করে থাকে ইরান। তাই ইরানে ইসরাইলের প্রতিশোধমূলক হামলার সর্বোচ্চ নিশানায় রয়েছে এই দ্বীপ। ধারণা করা হচ্ছে, রোববার ৭ অক্টোবর ইসরাইলে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের হামলার বর্ষপূর্তিতে ইরানে এই হামলা চালাতে পারে ইসরাইল। যে হামলার নিশানা হতে পারে ইরানের পরমাণু স্থাপনা এবং খার্গ আইল্যান্ডে অবস্থিত জ্বালানি অবকাঠামো। ইসরাইলি পত্রিকা হারেৎজ দেশটির সামরিক সূত্রের বরাত দিয়ে এ ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়ে জানিয়েছে, সম্ভাব্য ইসরাইলি হামলা হবে তাৎপর্যপূর্ণ।
ইরানের অর্থনীতির ’প্রাণভোমরা’ খার্গ আইল্যান্ড
ইরানের উপকূল থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে পারস্য উপসাগরে অবস্থিত খার্গ আইল্যান্ডের টার্মিনাল থেকেই দেশটির তেলের ৯০ শতাংশ রফতানি হয়ে থাকে। যদি ইসরাইল সত্যিই সত্যিই এই দ্বীপে ইরানের তেল রফতানিতে ব্যবহৃত টার্মিনালগুলোতে হামলা চালায় তবে স্থবির হয়ে পড়তে পারে ইরানের অর্থনীতি। কারণ তেল সমৃদ্ধ দেশটির অর্থনীতির বেশির ভাগ রাজস্বই আসে জ্বালানি রফতানি থেকে। মূলত এই টার্মিনাল থেকে তেলবাহী জাহাজে ভরা হয় ইরানের অপরিশোধিত তেল। যার গন্তব্য চীনসহ অন্যান্য এশীয় দেশগুলো। মূলত এই দেশগুলোই ইরানের তেলের সবচেয়ে বড় গ্রাহক। যদিও ইরানের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তারপরও দেশটি বিপুল পরিমাণ তেল উত্তোলন ও রফতানি করে থাকে। বর্তমানে দিনে প্রায় ৪০ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন করে ইরান, বিশ্ববাজারে রফতানি করে থাকে প্রায় ২০ লাখ ব্যারেল, যার প্রায় পুরোটাই জাহাজে ভরা হয় খার্গ আইল্যান্ডে।
খার্গ আইল্যান্ডে হামলা হলে শুরু হবে যুদ্ধ
ইসরাইল যদি খার্গ আইল্যান্ডে হামলা চালায় তবে প্রতিদিন ইরানের সরবরাহের করা ২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল থেকে বঞ্চিত হবে বিশ্ববাজার। এর তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়বে বিশ্বের জ্বালানি বাজারে। তবে খার্গ আইল্যান্ডে ইসরাইলের হামলার সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া মারাত্মক হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইরানের অর্থনীতির ‘লাইফলাইন’ হিসেবে পরিচিত এই দ্বীপ যেহেতু দেশটির জন্য খুবই স্পর্শকাতর, তাই এই দ্বীপে ইসরাইলি হামলার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ইরান ইতোমধ্যেই ইসরাইলকে বাড়াবাড়ি না করার হুমকি দিয়ে বলেছে, যদি ইসরাইল ইরানের তেল অবঠাকামো কিংবা পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালায় তবে তারা ইসরাইলের চেয়েও মারাত্মক হামলা চালাবে। ইসরাইলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরপরই ইরানের সামরিক বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাকেরি বলেন, ‘ইরানের ধৈর্য ধারণের দিন শেষ হয়েছে, আমরা (১ অক্টোবর) মঙ্গলবার শুধু ইসরাইলের সামরিক ও গোয়েন্দা স্থাপনায় হামলা চালিয়েছি, এবং অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও শিল্প স্থাপনাগুলোতে হামলা থেকে বিরত থেকেছি। কিন্তু ইসরাইল যদি জবাব দেয়, তবে আমাদের প্রতিক্রিয়া হবে আগের থেকেও বিধ্বংসী।’
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এর মধ্য দিয়ে প্রকারন্তরে যুদ্ধের বার্তায় দিয়ে রেখেছেন ইরানের এই শীর্ষ সামরিক কর্তা।
খার্গ আইল্যান্ডে হামলা হলে তেলের দাম ওঠবে ১৫০ ডলারে
খার্গ আইল্যান্ডে ইসরাইলি হামলার প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বের জ্বালানি তেলের বাজারে অস্থিরতা শুরু হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে জ্বালানি বিশ্লেষকরা। গোল্ডম্যান স্যাকস জানিয়েছে, যদি ইরানি জ্বালানি উৎপাদন বিঘ্নিত হয় তবে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ২০ ডলার বেড়ে যেতে পারে। কারণ খার্গ আইল্যান্ডে হামলার প্রতিক্রিয়ায় যদি ইরান বিশ্বের জ্বালানি সরবরাহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রুট হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয় তবে সত্যিই সত্যিই পুরো বিশ্ব জ্বালানি সংকটে ভুগতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। কারণ ইরান আগেই হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে, তার তেল উৎপাদন ও রফতানি স্থাপনা ও অবকাঠামোতে যে কোনো হামলার প্রতিক্রিয়ায় হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেবে তারা। বিশ্বের দৈনিক তেল উৎপাদনের ২০ ভাগই সরবরাহ হয় হরমুজ প্রণালি দিয়ে। শুধু ইরানই নয়; ইরাক, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবেরও রফতানি করা অধিকাংশ তেলই এই হরমুজ প্রণালি দিয়ে পার হয় । যদি খার্গ আইল্যান্ডে হামলাকে কেন্দ্র করে সত্যিই পুরোদস্তুর লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে ইরান ও ইসরাইল এবং এর প্রতিক্রিয়ায় যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ১৫০ ডলারে ওঠে যেতে পারে বলে জানিয়েছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ফিচ সল্যুশন।
ইসরাইলি হামলার পরিকল্পনায় সায় নেই যুক্তরাষ্ট্রের
তবে খার্গ আইল্যান্ডে ইরানের তেল অবকাঠামো কিংবা দেশটির পরমাণু অবকাঠামো লক্ষ্য করে ইসরাইলের হামলার পরিকল্পনায় সায় নেই হোয়াইট হাউসের। গত শুক্রবার (৪ অক্টোবর) এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। মূলত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে এই মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাক- এমনটা চাইছে না হোয়াইট হাউসের বর্তমান প্রশাসন। খার্গ আইল্যান্ডে হামলার প্রতিক্রিয়ায় যদি সত্যিই ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয় তাহলে বিশ্বের জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনীতির ওপর এর যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে ভোট সামনে রেখে তা কাম্য নয় ওয়াশিংটনের। এ কারণেই ইরানে হামলার ইসরাইলি পরিকল্পনায় সায় দিচ্ছে না হোয়াইট হাউস।
ইরানের শত্রুদের টার্গেটে বরাবরই ছিল খার্গ আইল্যান্ড
সবসময়ই ইরানের শত্রুদের হামলার নিশানায় ছিল খার্গ আইল্যান্ড। আজ থেকে ৪৫ বছর আগে ইসলামি বিপ্লবের পর যখন ইরানে অবস্থান করা মার্কিন কূটনীতিকদের জিম্মি করে বিপ্লবীরা, তার জবাবে খার্গ আইল্যান্ডে হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। তবে পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন তিনি। তবে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় অবশ্য সাদ্দাম হোসেন বিমান হামলা চালান খার্গ আইল্যান্ডকে লক্ষ্য করে। অবশ্য এই হামলায় খুব সামান্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যাপকভাবে সুরক্ষিত এই দ্বীপ।
সিআইএ সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, ইরাকি বোমারু বিমানগুলো এই দ্বীপের প্রায় সবগুলো টার্গেটই মিস করে। বেশির ভাগ বোমা পড়ে দ্বীপ সংলগ্ন সমুদ্রে। কারণ এই দ্বীপের সুরক্ষায় মোতায়েন থাকা বিপুল সংখ্যক বিমান বিধ্বংসী কামান ও ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্টা হামলা থেকে বাঁচতে বোমারু বিমানগুলোকে মাটি থেকে অনেক উঁচুতে থেকে হামলা চালাতে হয়।
খার্গ আইল্যান্ডে হামলা চালানো সহজ হবে না ইসরাইলের
যদিও ৮০’র দশকে খার্গ আইল্যান্ডে হামলা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল ইরাকি বিমানবাহিনী। তবে ইসরাইলের সামরিক সামর্থ্য ইরাকের থেকে অনেক বেশি। তাই ইরানের মাটিতে যে কোনো স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র কিংবা বিমান হামলা চালাতে ইসরাইলের তেমন বেগ পেতে হবে না বলেই মনে করছেন অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির টেরোরিজম ও কাউন্টার টেরোরিজম বিশেষজ্ঞ লেভি ওয়েস্ট। তার মতে, এক্ষেত্রে ইরান ও ইসরাইলের মাঝে থাকা নিজেদের দুই মিত্র রাষ্ট্র সৌদি আরব ও জর্ডানের সহযোগিতা পাবে ইসরাইলি জঙ্গি বিমান।
তিনি বলেন, এক্ষেত্রে তাদের আকাশসীমায় রিফুয়েলিংয়ের সুযোগ পাবে ইসরাইলি জঙ্গি বিমান। অবশ্য যতটা ভাবা হচ্ছে ইসরাইলের জন্য ততটা সহজ নাও হতে পারে খার্গ আইল্যান্ডে হামলা চালানো। কারণ ইরানের হাতে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম ভয়ংকর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রাশিয়ায় নির্মিত এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেম। গুরুত্ব বিবেচনায় খার্গ আইল্যান্ড এই এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা সুরক্ষিত বলেই মনে করা হয়। ইসরাইলের পাঠানো যে কোনো জঙ্গি কিংবা বোমারু বিমানকে ভূপাতিত করার সক্ষমতা এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্রের রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।