কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের সংঘাতের ইতিহাস রয়েছে। দুই দেশের অভিন্ন দীর্ঘ সীমান্তে এমন কিছু বনাঞ্চল আছে যা উভয় দেশই নিজেদের বলে দাবি করে আসছে। আর এ কারণেই মাঝে মাঝেই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে প্রতিবেশি দুই দেশ।
অতীতেও উভয় দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে গুরুতর গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে। যেমন ২০০৮ ও ২০১১ সালেও একই মাত্রার সংঘর্ষ ঘটে। তাতে ৪০ জন নিহত হয়েছিল। তবে এসব সংঘর্ষ দ্রুতই থেমে গিয়েছিল।
এমনকি সম্প্রতি গত মে মাসে একজন কম্বোডীয় সেনা নিহত হওয়ার পরও উভয় পক্ষই সহিংসতা রোধে আগ্রহী ছিল। উত্তেজনা প্রশমনের লক্ষ্যে দুই দেশের সেনা কমান্ডারদের মধ্যে বৈঠকও হয়েছিল।
কিন্তু গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) ভোরে আবারও সংঘর্ষ শুরু হয়। এবং এই সংঘর্ষ শুক্রবার (২৫ জুলাই) দ্বিতীয় দিনে গড়িয়েছে। থাই কর্তৃপক্ষ বলেছে, এখন পর্যন্ত তাদের অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছেন এবং আরও ৪৬ জন আহত হয়েছেন। বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।
অন্যদিকে কম্বোডিয়ার প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষ বলছে, থাই হামলায় তাদের একজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন এবং পাঁচজন আহত হয়েছেন বলে জানানো হয়েছেন।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মালয়েশিয়া দুই দেশের মধ্যে সংঘাত নিরসনে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে সংঘাত বন্ধে তৃতীয় কোনো দেশের মধ্যস্থতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে থাইল্যান্ড।
শুক্রবার থাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নিকোরন্দেজ বালানকুরা বলেন, ‘আমি মনে করি না আমাদের এখনও তৃতীয় কোনো দেশের মধ্যস্থতার প্রয়োজন আছে।’
ফের কেন এই সীমান্ত সংঘাত
চলতি বছরের মে মাসে ছোট একটি সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি ঘটে। তাতে এক কম্বোডীয় সেনা নিহত হন। উভয় পক্ষই তখন দাবি করে, তারা আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়। যদিও পরে দুই দেশ উত্তেজনা হ্রাসে একমত হয়। তবে সীমান্তে কড়াকড়ি, নিষেধাজ্ঞা ও বাগযুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
থাইল্যান্ড সীমান্তে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, যার ফলে শুধু ছাত্র, চিকিৎসাপ্রার্থী ও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো মানুষ যাতায়াত করতে পারছিল না। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) থাইল্যান্ড পুরো সীমান্তই বন্ধ করে দেয়।
জবাবে কম্বোডিয়া থাই চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন নিষিদ্ধ করে। সেই সঙ্গে থাইল্যান্ড থেকে জ্বালানি, গ্যাস, ফলমূল ও সবজি আমদানিও বন্ধ করে দেয়। সীমান্তে বিভিন্ন চেকপোস্টও বন্ধ রাখা হয়।
এর মধ্যে গত বুধবার (২৩ জুলাই) সীমান্তে পুঁতে রাখা একটি ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে এক থাই সেনা তার একটি পা হারান। এর আগে গত ১৬ জুলাইও একইভাবে মাইন বিস্ফোরণে আরও তিন থাই সেনা আহত হন।
থাই কর্তৃপক্ষ এই মাইন পুঁতে রাখার জন্য কম্বোডিয়াকে দায়ী করে। তবে কম্বোডিয়া তা অস্বীকার করে বলে, থাই সেনারা তাদের জন্য নির্ধারিত পথ থেকে সরে পুরোনো যুদ্ধকালীন বিস্ফোরকে পা দিয়েছিলেন।
এ ঘটনার পর থাইল্যান্ডের ফেউ থাই পার্টি নেতৃত্বাধীন সরকার কম্বোডিয়ায় নিযুক্ত থাই রাষ্ট্রদূতকে দেশে ফিরিয়ে আনা ও থাইল্যান্ডে নিযুক্ত কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়। পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কও ‘কমিয়ে আনা’র ঘোষণা দেয়া হয়।
দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ
থাইল্যান্ড ও কাম্বোডিয়ার ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত বহু দশক ধরেই বিরোধপূর্ণ। এ বিরোধের মূল উৎস ১৯০৭ সালে ফরাসি উপনিবেশিক শাসনামলে আঁকা একটি মানচিত্র, যেটাকে ভিত্তি হিসেবে ধরে কিছু এলাকা দাবি করছে কম্বোডিয়া। অন্যদিকে থাইল্যান্ড সেই মানচিত্র প্রত্যাখ্যান করে আসছে।
সবচেয়ে বেশি বিরোধ রয়েছে প্রায় এক হাজার বছরের পুরোনো প্রেয়া ভিহেয়ার মন্দির নিয়ে। ১৯৬২ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) এই মন্দির এলাকার মালিকানা কম্বোডিয়াকে দেয়।
এরপর ২০১১ সালে নতুন করে সংঘর্ষের পর কম্বোডিয়া আবার আইসিজের দ্বারস্থ হয় ও ২০১৩ সালে আদালত আবারও তাদের পক্ষে রায় দেয়। বর্তমানে কম্বোডিয়া আবার আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে। তবে থাইল্যান্ড সেই আদালতের এখতিয়ার মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
থাই রাজনীতিতে সংকট
এই সংঘাত থাইল্যান্ডে রাজনৈতিক অস্থিরতাও সৃষ্টি করেছে। চলতি জুলাই মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রার এক ফোনালাপ ফাঁস হয়। সেই ফোনালাপে পেতংতার্ন কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেনকে ‘চাচা’ বলে সম্বোধন করেন এবং নিজ দেশের সেনাবাহিনীর সমালোচনা করেন। বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হয় বিরোধীরা। তারা এটাকে জাতীয় মর্যাদার অবমাননা বলে দাবি করে।
ফোনালাপ ফাঁসের পর দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ও তার নেতৃত্বাধীন ফেউ থাই জোট সরকারের অন্যতম প্রধান শরিক দল ভুমজাইথাই সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। এরপরই পেতংতার্নাকে বরখাস্ত করা হয়। গঠিত হয় নতুন সরকার। যার ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী করা হয় সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফুমথাম ওয়েচায়াচাইকে। তথ্যসূত্র: বিবিসি ও এপি