দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ। ঘুষ আগের চেয়ে কমলেও হয়রানির শিকার মানুষেরা বলছেন, ৭৪ শতাংশ ক্ষেত্রে টাকা ছাড়া কিছু হয় না।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) জরিপে এই চিত্র উঠে এসেছে। এতে সমাজের নানা আর্থিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক উদ্বেগের কারণে প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষ ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা হারিয়েছেন।
সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) রাতে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠিত ‘পরিবার পর্যায়ে মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান’ শীর্ষক এক আলোচনায় সংস্থাটির সাম্প্রতিক জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়। গত মে মাসে দেশের ৮ হাজার ৬৭টি খানার মধ্যে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান।
জরিপের পারিবারিক মনস্তত্ত্ব অংশের ফলাফল তুলে ধরে বলা হয়, প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ আর্থিক সংকটের মধ্যে আছে। এদের মধ্যে ৬৭ শতাংশ চিকিৎসা ব্যয় এবং ২৭ শতাংশ ঋণ পরিশোধ নিয়ে সংকটে আছেন।
হয়রানি ও ঘুষ
ঘুষের বিষয়ে বলা হয়, সরকারি কার্যালয় ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় ঘুষ নেওয়ার প্রবণতা কমেছে।
জরিপে এই প্রথম হয়রানির দিকটি তুলে আনা হয়েছে। এতে দেখা যায়, হয়রানির শিকার ৭৪ শতাংশ মানুষ বলছেন, টাকা না দিলে কিছুই হয় না। সরকারি সেবা নিতে হয়রানির শিকার হন ২১ শতাংশ মানুষ। স্বাস্থ্যসেবায় এই হার প্রায় ৪৯ শতাংশ।
জরিপে মানুষের উদ্বেগের কারণগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ দ্রব্যমূল্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। সন্তানের শিক্ষা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন ৬৫ শতাংশ মানুষ। এ ছাড়া কিশোর অপরাধ এবং মাদক নিয়ে উদ্বিগ্ন ৫৫ এবং ৫৬ শতাংশ মানুষ।
ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষা
ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার বিষয়ে মানুষ ৫৩ শতাংশ ক্ষেত্রে সামাজিক সম্মানের কথা বলেছেন। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি চান তারা। রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষর বিষয়ে ৫৬ শতাংশ মানুষ দুর্নীতি প্রতিরোধের কথা বলেছেন।
সার্বিকভাবে নানা সংকট ও উদ্বেগের কারণে প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষ ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা হারালেও ৫৪ শতাংশ মানুষ এখনো হাল ছেড়ে দিতে নারাজ।
সেমিনারে প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, রাষ্ট্রকে কাঠামোগতভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে গোষ্ঠীতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে। এখানে যারা সংগঠিত তারা সুবিধা নিচ্ছে, কিন্তু জনগণ অসংগঠিত থাকায় তাদের ভাগ পাচ্ছে না। আগে সমাজে অর্থ উপার্জন তৃতীয় প্রধান বিষয় থাকলেও এখন মানুষ যেকোনো উপায়ে অর্থ উপার্জনে প্রাধান্য দিচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়া বাংলাদেশের চেয়ে বেশি লড়াকু মনোভাব কারও নেই। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত এই মনোভাবই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সমস্যা জিইয়ে রাখা হচ্ছে
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ প্রশ্ন তোলেন, ‘এত বড় বিপ্লবের পর ৪৬ শতাংশ মানুষ কেন ভরসা রাখতে পারছে না।’ তিনি আরও বলেন, নারী ও সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভয় বাড়ছে। সমাজে প্রতিনিয়ত সংঘাতমূলক মনোভাব ছড়াচ্ছে। একদিকে দেশে কর্মসংস্থান নেই, অন্যদিকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগও কমছে। শিক্ষার্থীদের ঠিকভাবে ক্লাসে আনা যায়নি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো গুমোটভাব আছে।
সমস্যা জিইয়ে রাখা হচ্ছে অভিযোগ করে আলতাফ পারভেজ বলেন, ৭ কলেজ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় করার কার্যক্রম এক বছরেও সমাধান করা যায়নি। এটি নিয়ে অনবরত রাস্তা, অবরোধ হুমকি–ধমকি চলছে। উচ্চকক্ষ নিম্নকক্ষ নিয়ে প্রতিদিনকার বিবাদ টেলিভিশনের মাধ্যমে ভুরুঙ্গামারী পর্যন্ত ছড়িয়ে যাচ্ছে।
জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি
বাংলাদেশ জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ডক্টরাল ফেলো আসিফ বিন আলী। তিনি বলেন, তরুণদের বড় অংশ এখন আশাবাদী নয়। জুলাই তরুণদের ক্ষোভ আরও বাড়তে পারে, এবং সেটা নেপালের মতো সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যেতে পারে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের স্বপ্নকে মানুষের অর্থনৈতিক সুবিধায় পরিণত করার আলাপ নেই। ফলে সমাজে যেকোনো চরমপন্থা জায়গা করে নিতে পারে। সেটা হতে পারে ধর্মীয় চরমপন্থা। দেশ এখন জনতুষ্টিবাদীর জন্য প্রস্তুত, যেখানে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীরা বেশি সমর্থন পাচ্ছে।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকসের (দায়রা) গবেষক ভূঁইয়া মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, তরুণদের ক্ষোভ বাড়লেও তাতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দুর্বল হবে না। কারণ প্রতিষ্ঠানগুলোর অপ্রাতিষ্ঠানিক পরিচালনা পদ্ধতির কারণেই ক্ষোভ বাড়ছে। কেন বারবার অভ্যুত্থান হলেও সংস্কার করা যায়নি, সেটি বড় প্রশ্ন। হয়রানির বিষয়গুলো অর্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, বরং কাগজে–থাকলেও বাস্তবে সেবা না পাওয়ার কারণে তা হচ্ছে। শহরাঞ্চলে হয়রানির প্রবণতা বেশি। শহরে ভাসমান মানুষ বেশি থাকায় এটা হতে পারে। এটার কারণ আরও খতিয়ে দেখা যেতে পারে। এই জরিপ প্রতিবছর পরিচালনার আহ্বান জানান তিনি।
মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মানুষের বড় অংশ আশাবাদী নয়, এটা হতাশাজনক। কেন এত দ্রুত মানুষের একটি বড় অংশের আশা চলে গেল, সেটা গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে।
এই জরিপ প্রতিবছর পরিচালনা করা হবে বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়। আরটিভি