Kazi Azizul Huq
Abdul-Baten Miaji:
সুলতান মুহাম্মদ ঘুরী ভারত-বিজয়ের পর আজমীরে খাজা গরীবে নেওয়াজের দরবারে গিয়ে হাজিরা দিলেন। তিনটা পরামর্শ দিলেন গরীবে নেওয়াজ:
১. জনগণের উপর জুলুম করা যাবে না।
২. রাজ পরিবারের সাথে মর্যাদা অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে।
৩. হিন্দুদের মন্দির, দেবদেবীর উপর আঘাত করা যাবে না।
ঘুরী আজমীর শরীফ থেকেই নির্দেশ দিলেন: কেউ যদি হিন্দুদের উপাসনালয়ে আঘাত করে তাইলে তার খবর আছে। সাথে সাথে পৃথ্বীরাজের ছেলেকে নিজের সৈন্যদলে অন্তর্ভুক্ত করলেন।
যে কারণে ঘুরীর বিরুদ্ধে স্থানীয় কোনো বিদ্রোহ হয় নাই।
গৌড় গোবিন্দরে পরাজিত করার পর হজরত শাহজালাল ঠিক তাই করছিলেন। জনগণের উপর কোনো জুলুম করা হয় নাই। তিনি নিজে ক্ষমতাও নেন নাই; সিকান্দার শাহকে সিলেটের শাসনক্ষমতায় বসাইছেন।
কাউরে ধর্মের দাওয়াত দিয়া বিরক্ত করেন নাই। উল্টা স্থানীয় হিন্দুরা শাহজালালের দরবারে গিয়ে হাজিরা দিছে। ইবনে বতুতার রেহলাতে এই কথা আছে।
আবদুল ওহাব নজদি ক্ষমতা পাওয়ার পর সাহাবায়ে কেরাম এবং অন্যান্য আলেমদের মাজার ভাঙলেন। ফতোয়া দিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও দিলেন মাজার ভাঙার পক্ষে। আরবের সুফিদের হ-ত্যা করতে দুইবার ভাবে নাই।
অনেকে সৈয়দ আহমদ শহীদের তরিকায়ে মোহাম্মদিয়াতে নজদিয়্যত খুঁজে পান। কিন্তু আমি দেখি উল্টা।
সৈয়দ আহমদ শহীদ নিজে সুফি তরিকার লোক ছিলেন। আবদুল আজিজ মোহাদ্দেস দেহলভীর সূত্রে কাদেরিয়া, চিশতিয়া ও নকশবন্দিয়া তরিকায় খেলাফতপ্রাপ্ত ছিলেন। উত্তর প্রদেশের অনেক খানকায়, এলাহাবাদের বিখ্যাত পীর শাহ আশরাফের মাজার জেয়ারত ও ফুলওয়ারী দরবারের খানকাতেও গেছিলেন। তার মুজাহিদ বাহিনীতে মিনিমাম ৫০ ভাগ ছিলেন সুফি তরিকার লোক।
বালাকোট আন্দোলনের পর সৈয়দ আহমদের অনেক শিষ্য বাংলায় ফিরে আসছিলেন। বেশিরভাগই ছিলেন সুফি, পীর দরবেশ। যে কারণে দেখবেন বাংলাদেশের অনেক বৃহৎ দরবারের সিলসিলা আসছে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মাধ্যমে।
বাংলার বা ভারতের এমন কোনো শাসক ছিলেন না যার সাথে কোনো না কোনো সুফির ঘনিষ্ঠতা ছিল না। অনেকটা ধর্ম উপদেষ্টার মতো। এমন অনেক নজির আছে, ধর্মীয় সমস্যার সমাধানের জন্য শাসক নিজে গেছেন অথবা দূত পাঠাইছেন সুফির দরবারে।
যে কারণে বাংলায় অন্তত ধর্ম নিয়া কোনো বিদ্রোহ হয় নাই। সুফিরা জানেন, ধর্ম আর ক্ষমতা কিভাবে ডিল করতে হয়।
ভারতবর্ষের মধ্যে কেবল বাংলায় কেন এত এত মুসলমান হইছে তা নিয়া এখনো পর্যন্ত অবাক হন গবেষকরা। একটা কারণ হইলো, সুফিরা কখনো ধর্ম প্রচারের জন্য ক্ষমতারে ব্যবহার করেন নাই।
ধর্ম যখন ক্ষমতাচর্চার হাতিয়ার হয়ে উঠে তখন আর তা ধর্ম থাকে না; ক্ষমতারই আরেকটা রূপে পরিণত হয়। মদিনায় রওজায়ে পাকের সামনে আশেককে বাঁধা দিতে, বিপর্যস্ত করতে সৌদির পুলিশ দাঁড়াইয়া থাকে না? এইটা হইলো ক্ষমতা। কিন্তু পুলিশরে পিছনে ফেলে আশেকরা আরজি জানায়, এইটা হইলো ধর্ম।
ধর্ম আর ক্ষমতারে কিভাবে ডিল করতে হবে এইটা বুঝতে হবে সুফির দরবারে। সুফিদের তরিকা অনুযায়ী যদি ধর্মকে ক্ষমতাচর্চার হাতিয়ার না বানান তাহলে মুসলমানের সংখ্যা অটোমেটিক বাড়বে আর আবদুল ওহাব নজদির তরিকা অনুযায়ী যদি ধর্মকে ক্ষমতাচর্চার হাতিয়ার বানান তাহলে মুসলমানের সংখ্যা কমবেই না খালি, বরং বিদ্বেষ বাড়বে।
বাংলায় যে ইসলাম বিদ্বেষ আমরা দেখি তার পেছনে আবদুল ওহাব নজদির আদর্শের দায় আছে।
বাংলাদেশে মাজার বিদ্বেষ ও মাজার ভাঙার যে প্রজেক্ট তা সরাসরি আবদুল ওহাব নজদির তরিকা। সুফিসমাজ কিছু বলবে না। কিন্তু দেখবেন, যত মাজার ভাঙছেন তত বাড়তেছে মাজারপ্রীতি। এইটারে বলে, নীরব বিপ্লব।
মাজারবিদ্বেষী যে হুজুর একশ ঘন্টা ওয়াজ করে আপনারে হেদায়েত করতে পারে নাই, একজন সুফি মুচকি হাসিই সেজন্য যথেষ্ঠ। মানুষের মনের উপর যে কোনো জোরজবরদস্তি চলে না তা হুজুর জানে না, সুফি জানেন। জানেন বলেই তিনি মনের উপর রাজত্ব কায়েম করেন।
সুফিরা ক্ষমতায় থাকেন না, কিন্তু ক্ষমতা সুফিদের দরবারে গিয়ে হাজিরা দেয়। তাঁরা ধমকি দেন না, ইশারা দেন। তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন না, পরিচালনার সিস্টেম বাতলাইয়া দেন। তারা জোরজবরদস্তি করেন না, মহব্বত করেন।
সুফিরা মহব্বতের কারবার করেন। জাহেলী যুগের অসংখ্য পাপতাপে জীর্ণ শীর্ণ মানুষকে মহব্বতের মাধ্যমে যে রাসুল নিষ্পাপ সোনার মানুষে পরিণত করছেন তা সুফিদের জানা আছে। সুফিরা রাসুলের অনুসারী, আবদুল ওহাব নজদির না।
কৃত: মুহাম্মদ আবু সায়ীদ। - প্রেরকঃ কাজী আজিজুল হক