সিলেটে নিহত রফিকুল ইসলাম ও তার ছেলে মাহিকুল ইসলামের দাফনের সময় সেখানে জড়ো হন গ্রামের কয়েকশ মানুষ। ছবি বিবিসি বাংলা।
সিলেটে যুক্তরাজ্য-প্রবাসী এক পরিবারের দু'জনের মৃত্যু এবং বাকি তিনজন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনায় রহস্য এখনও কাটেনি। এবিষয়ে পুলিশ এখনও কিছু ধারণা করতে পারছে না।
ওই পরিবারটি ওসমানীনগরে ভাড়া করা একটি ফ্ল্যাটে অবস্থান করছিল।
মঙ্গলবার সকালে পুলিশ রুমের দরজা ভেঙে পরিবারের সবাইকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর কার্ডিফ প্রবাসী ৫১ বছর বয়সী পিতা রফিকুল ইসলাম এবং তার ছোট ছেলে ১৬ বছর বয়সী মাহিকুল ইসলামের মৃত্যু হয়।
মি. ইসলামের স্ত্রী এবং বাকি দুই সন্তান হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট বা আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন।
নিহত দু'জনের পোস্টমর্টেম করা হয়েছে। কিন্তু রিপোর্ট এখনও আসেনি।
এই ঘটনায় ওসমানীনগর থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে এখনও কাউকে আটক করা হয়নি।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়ার পর তারা পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। তারা আশা করছেন আগামী দু'একদিনের মধ্যেই এই রিপোর্ট তাদের হাতে এসে পৌঁছাবে।
ওসমানীনগর থানার তদন্ত কর্মকর্তা মাছুদুল আমিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, "যারা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারলেও ধারণা করা যাবে সেদিন রাতে আসলে কী হয়েছিল। আমরা তাদের সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছি।"
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
পরিবারটির পরিচয়
রফিকুল ইসলাম ছিলেন একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার। তার জন্ম বাংলাদেশের সিলেটে।
পিতার ব্রিটিশ নাগরিকত্বের সূত্র ধরে ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি যুক্তরাজ্যে চলে আসেন।
এই পরিবারটি ওয়েলসের রাজধানী কার্ডিফের রিভারসাইড এলাকায় বসবাস করে। মি. ইসলামের দুই ভাই, এক বোন এবং মা-ও থাকেন কার্ডিফ শহরে। পরিবারটির এই অবস্থার পর তাদের সবাই সিলেটে ছুটে গেছেন।
কার্ডিফে মি. ইসলামের আত্মীয়রা জানিয়েছেন যে ১২ই জুলাই এই পরিবারটি দু'মাসের জন্য বাংলাদেশে যায়।
তার আগে পরিবারটিকে বিদায় জানাতে তারা সবাই কার্ডিফে একত্রিত হয়েছিলেন।
নিহত রফিকুল ইসলামের বোনের স্বামী আব্দুল মুমিন খান কার্ডিফ থেকে বিবিসি বাংলাকে বলেন, মূলত পরিবারের বড় ছেলের চিকিৎসার জন্যই তারা বাংলাদেশে গিয়েছিলেন।
"বড় ছেলের নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা আছে। ইংল্যান্ডে বহু বছর ধরে চিকিৎসা করিয়েও কোনো উন্নতি হয় নি। লন্ডনের প্রাইভেট হাসপাতালেও তার চিকিৎসা করানো হয়েছে। তাই পরিবারটি তাদের ছেলেকে ঢাকায় নিয়ে ডাক্তার দেখানোর জন্য বাংলাদেশে যান," বলেন তিনি।
মি. খান জানান পরিবারটি সপ্তাহ-খানেক ঢাকার একটি হোটেলে অবস্থান করে। এসময় বড় ছেলেকে হাসপাতালেও ভর্তি করা হয়।
চিকিৎসা শেষে তারা চলে যান সিলেটে।
ফ্ল্যাট ভাড়া
আব্দুল মুমিন খান জানান, সিলেটে বন্যার কারণে পরিবারটি ওসমানীনগরের তাজপুর এলাকায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করেন।
"ওনার (নিহত রফিকুল ইসলাম) এবং ওনার শ্বশুরের গ্রামের বাড়ি পাশাপাশি। বন্যার পানিতে তাদের গ্রাম ডুবে যাওয়ায় সেখানে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। তাই তারা তাজপুরে চারতলা বিল্ডিং-এ তিন রুমের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করেন।"
ওই ফ্ল্যাটে ওঠেন নিহত রফিকুল ইসলামের শ্বশুর, শাশুড়ি, এক শ্যালক, শ্যালকের স্ত্রী এবং তাদের এক শিশু সন্তান। রফিকুল ইসলামের স্ত্রী তার মামাত বোন।
বাড়ির দ্বিতীয় তলার ওই ফ্ল্যাটে দুটো পরিবার দুটো ঘরে থাকতো।
সেখানে তারা নিজেরাই রান্না বান্না করে খাওয়া দাওয়া করতেন।
ওই রাতের ঘটনা
পরিবারের সদস্যরা বলেন, সোমবার ২৫শে জুলাই রাতেও তারা একসঙ্গে খাবার দাবার খেয়ে আলাদা আলাদা ঘরে ঘুমাতে চলে যান।
পরদিন মঙ্গলবার বেলা বেড়ে গেলেও রফিকুল ইসলামের পরিবার ঘুম থেকে না ওঠায় পাশের ঘরে থাকা শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তাদের দরজায় ধাক্কাধাক্কি করেন।
অনেক সময় ধরে ডাকাডাকির পরেও কেউ সাড়া না দিলে তারা জানালা দিয়ে দেখতে পান ওই পরিবারের পাঁচজন সদস্য দুটো বিছানায় এলেমেলো হয়ে শুয়ে আছেন।
খবর পেয়ে সেখানে ছুটে আসেন নিহত রফিকুল ইসলামের আরেক শ্যালক সেবুল মিয়া।
ওসমানীনগর থেকে বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, "সকাল ১১টার দিকে খবর পেয়ে আমি ওই ফ্ল্যাটে যাই। কেউ কেউ দরজা ভাঙার কথা বলছিল। আমি তখন বলি পুলিশকে না জানিয়ে দরজা ভাঙা ঠিক হবে না।"
তখন তারা জরুরি ৯৯৯ নম্বরে কল করে পুলিশকে খবর দেন।
"পুলিশ এসে দরজা ভেঙে ফেলে। আমরাও তাদেরকে সাহায্য করি। ভেতরে ঢুকে দেখি সবাই অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। আমি দেখি তাদের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে," বলেন তিনি।
এই অবস্থায় পাঁচজনকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা জানান মি. ইসলাম এবং তার ছোট ছেলে মারা গেছেন।
বাকি তিনজনকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
কী হয়েছিল
ওই রাতে ফ্ল্যাটে কী হয়েছে, কী কারণে ওই পরিবারের দুজন নিহত হলেন এবং বাকি তিনজন মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন- এবিষয়ে পুলিশ এখনও কিছু ধারণা করতে পারছে না।
নিহতদের পোস্ট মর্টেম করা হয়েছে কিন্তু তার রিপোর্ট এখনও পাওয়া যায়নি।
ওসমানীনগর থানার তদন্ত কর্মকর্তা মাছুদুল আমিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, "এখনও আমরা পুরোপুরি কিছু বুঝতে পারছি না। ডাক্তাররাও কিছু বলতে পারছেন না যে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে কি না। ডাক্তারের মতামত পাওয়ার পরেই আমরা বুঝতে পারবো।"
তিনি জানান, পোস্টমর্টেম চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছে। দু-একদিনের মধ্যে এর রিপোর্ট পাওয়া যাবে।
"এছাড়াও যারা হাসপাতালে আছেন তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারলেও অনেক কিছু জানা যাবে। কিন্তু তাদের অবস্থা এখনও কথা বলার পর্যায়ে আসেনি," বলেন ইন্সপেক্টর আমিন।
তিনি জানান নিহত রফিকুল ইসলামের শ্বশুর, শাশুড়ি, শ্যালক ও শ্যালকের স্ত্রী সুস্থ আছেন। এদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশ বলছে ঘটনার পর থেকে তাদেরকে নজরে রাখা হয়েছে।
"জিজ্ঞাসাবাদের সময় তারা আমাদের বলেছেন যে রাত ১২টার দিকে ঘরে রান্না করা খাবার খেয়ে তারা ঘুমিয়ে ছিলেন। তারা সবাই একই খাবার খেয়েছেন। আত্মীয়দের ভাষ্যমতে ওই পরিবারের দু'জন ভাত খেয়েছেন আর বাকি তিনজন ফল-টল খেয়েছেন।"
তিনি বলেন, "আত্মীয়রা আমাদের বলেছেন- 'খাওয়া দাওয়ার পর তারা তাদের রুমে চলে গেছেন। আমরা আমাদের রুমে চলে গেছি। পরে সকাল সাড়ে দশটার দিকেও যখন দেখি তারা উঠছে না, তখন জানালা দিয়ে দেখি যে তারা অচেতন হয়ে পড়ে আছে, পরে তারা পুলিশকে ফোন করেন।"
খাবারে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল কি না পুলিশ এবিষয়েও কিছু ধারণা করতে পারছে না।
পুলিশের কর্মকর্তা মাছুদুল আমিন বলেন, "শ্যালকের স্ত্রী খাবার রান্না করেছিলেন। তারা বলেছেন যে সবাই মিলে একসাথে বসে একই খাবার খেয়েছেন। কিন্তু তারপরেও কেউ কেউ সুস্থ আবার কেউ কেউ অসুস্থ, কিছু বোঝা যাচ্ছে না। আসলে কে কী খেয়েছিল আমরা তো সেটা এখনও নিশ্চিত করে জানি না।"
তিনি বলেন মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে জানা গেলে হয়তো কিছু একটা ধারণা করা যাবে।
পুলিশ ওই ফ্ল্যাট থেকে খাবারের কিছু আলামত সংগ্রহ করেছে। তবে কী ধরনের খাবার সেবিষয়ে তারা কোনো মন্তব্য করেনি।
নিহত রফিকুল ইসলামের শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে (যারা ওই রাতে ফ্ল্যাটে ছিলেন) যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের কারো সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
বাকি তিনজন কেমন আছেন
পরিবারের বাকি তিনজন সদস্য সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
তাদের তিনজনই আছেন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউতে।
সেবুল মিয়া জানান নিহত রফিকুল ইসলামের মেয়েকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে।
স্ত্রী এবং বড় ছেলের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
নিহত রফিকুল ইসলাম এবং তার ছেলে মাহিকুল ইসলামকে বৃহস্পতিবার তাদের গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে। তথ্য সূত্র বিবিসি বাংলা।