News update
  • FAO Warns of ‘Silent Crisis’ as Land Loss Threatens Billions     |     
  • Indices tumble on both bourses amid broad-based sell-off     |     
  • BNP Names 237 Possible Candidates for Polls     |     
  • Bangladeshi leader of disabled people of world Dulal honoured     |     
  • UN Report Warns Inequality Fuels Global Pandemic Vulnerability     |     

লোক ও কারু শিল্পীদের চলছে টিকে থাকার লড়াই

গ্রীণওয়াচ ডেস্ক শিল্প-কারুশিল্প 2024-05-04, 4:38pm

hfwifew-909e86b1154b14980735cbd9f79ddb2e1714819137.jpg




বৈশাখে মেলা বসে ছোট্ট নদীর ধারে, কিংবা বটতলায়। বাহারি সব নামও থাকে সেইসব মেলার। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য সে ‘বৈশাখী মেলা’ হারাতে বসেছে তার লোকায়ত রূপ। মাটি, বাঁশ, বেত আর সূতার কাজে যে মানুষগুলোর মুনশিয়ানায় তৈরি হতো লোক ও কারু শিল্প, সে মানুষেরাও আজ লড়ছেন অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। বৈশাখী মেলায় মানুষকে বিনোদন দিতো যে নাগরদোলা, লাঠিখেলা, বাঁশিখেলা, পুতুলনাচ, লোকসংগীত, যাত্রা, পালাগান কিংবা বায়োস্কোপ- সবই আজ বিলীনপ্রায়। নদীর ধরে সাজানো সারি সারি শখের হাঁড়ি। কুমারদের গড়া সেই হাঁড়ি আজ মৃতপ্রায় নদীর মতোই সংকটে। সেই শখের হাঁড়ির মোটিফগুলো তখনকার কৃষিভিত্তিক সমাজের।

শখের কেন?

কারণ, ওর মধ্যে সৌখিন জিনিস ভরে মেয়ের বাড়িতে পাঠাতেন বাবা। এর সাথে আবার যোগ রয়েছে আমন ধানের। এই ধানের সাথেই বাড়তি ধান হিসেবে যে উৎপাদিত হতো আউশ ধান। সে আউশ ধান বিক্রি করে যা পাওয়া যেত, তার অধিকার মেয়ের। আউশ থেকে হাউস, অর্থাৎ শখ। সে অর্থ দিয়ে বাবা শখের হাঁড়ি কিনে মেয়ের বাড়িতে পাঠাতেন।

মজার বিষয়, ঈদের সময় বেশি বিক্রি হতো এই শখের হাঁড়ি। ঈদগার পাশেই কুমারেরা পসরা সাজিয়ে বসতেন শখের হাঁড়ির। নদী অববাহিকাতে এভাবেই গড়ে উঠেছে এই ব-দ্বীপের হাজারো বছরের গৌরবগাঁথা লোক ও কারু শিল্প। শখের হাঁড়ি, পট চিত্র, কাঠের পুতুল, হাত পাখা, জামদানি কিংবা টেপা পুতুল এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের রুচির বহি:প্রকাশ। সময়ের বিবর্তনে বদলেছে সমাজ। বদলেছে রুচি। বদলানোর স্রোতে ক্ষীণ হয়ে পড়েছে লোক ও কারু শিল্পের স্রোতধারা।

কেমন আছেন লোক ও কারু শিল্পীরা?

কাঠে চিত্রিত পুতুল, হাতি, ঘোড়া গড়েন শিল্পী বীরেন্দ্র সূত্রধর। এই শিল্প নিয়ে তিনি ঘুরে এসেছেন নেপাল আর শ্রীলঙ্কা। দেশের মেলাগুলোর পরিচিত মুখ বীরেন্দ্র সূত্রধর বলেন, যে পুতুল, বাঘ আমি গড়ি, তার মূল্য পাই না। চাইনিজ পণ্যে এখন বাজার ছেয়ে গেছে। বড় বড় কারুকাজ প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের কাছ থেকে পণ্য নিয়ে যান। কিন্তু টাকা বাকি রাখেন। যে বাঘটি আমি গড়ি তার জন্য পাই পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। কিন্তু চারুকলার কোনো শিল্পী যদি এটা তৈরি করেন, তাহলে তিনি পান লাখ টাকার ওপর।

বীরেন্দ্র জানান, পেট চলে না, তাই তিনি কাঠ পুতুলের পাশাপাশি রান্নার সামগ্রীও বিক্রি করেন। শখের হাঁড়ি শিল্পী মৃত্যুঞ্জয় পালের হতাশাও একইরকম। বাবা সুশান্ত কুমার পালের উত্তরাধিকার মৃত্যুঞ্জয় বলছেন, ইট-কাঠের অট্টালিকায় এখন আর ঠাঁই হয় না শখের হাঁড়ির। তাই তিনি এখন শখের হাঁড়ির পাশাপাশি মাটির নিত্য পণ্যও তৈরি করেন। গাইবান্ধার রঘুনাথ চক্রবর্তীর শিষ্য রতন পালের পটচিত্রে উঠে আসে গাজির পট, মনসা রামায়ণ আর মহাভারত। ১৪ বছর ধরে গুরুর কাছে পটচিত্র আঁকা শিখেছেন। ১৬ বছর ধরে নিজে আঁকছেন। তবু এই শিল্পের মানুষটির ঘর-সংসার চলে না। তার আক্ষেপ, এই শিল্পের কদর নেই।

নারায়ণগঞ্জের হোসনে আরা নকশী কাঁথা বোনেন। ফুল, পাখি, প্রাণী আর মানুষের মুখ ফুটিয়ে তোলেন কাঁথায়। তিনি তার তিন মেয়েকেও এই শিল্প শিখিয়েছেন। শুধু তাই নয়, হোসনে আরা তার গ্রামের নারীদেরও শেখাচ্ছেন নকশী কাঁথা বোনা। তাতে নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

তৃপ্তি নিয়ে হোসনে আরা বলেন, শেখাতে পারার আনন্দের তুলনা হয় না।

পঁচিশ বছর ধরে হাতপাখা তৈরি করেন বাসন্তী সূত্রধর। শাশুড়ির কাছ থেকে শিখেছেন। এই হাত পাখা বিক্রিতেই চলে তার সংসার। নকশাও তারাই তৈরি করেন। একটা ভালো পাখা তৈরিতে সারাদিন লেগে যায়। সূতা আর নকশা ভেদে একটা পাখার দাম দুইশ থেকে পাঁচশ টাকা। জামদানি কারিগর ইব্রাহিম মিয়ার নকশাটা থাকে তার মাথায়।

তিনি বলেন, যে কোনো নকশা একবার দেখলে তুলে ফেলতে পারি। সে নকশায় যে অপরূপ জামদানি বুনেন ইব্রাহিম৷ কিন্তু সেগুলোও খুব একটা বিক্রি হয় না। চিকন সূতার একটা ভালো জামদানি শাড়ি তৈরিতে তার মাস চলে যায়। আঠারো হাজার টাকা দামের সে জামদানির ক্রেতা নেই। তাই বেশির ভাগ জামদানি তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে।

রিকশা পেইন্টার এসএ মালেক চল্লিশ বছর ধরে এই শিল্পের সাথে জড়িত। বাবার কাছ থেকে শিখেছেন এই পপুলার আর্ট। এখন এই শিল্প পুরো ডিজিটাল। শুধু রিকশাতেই নয়, টি শার্ট, টি পট, ছবির ফ্রেমসহ নানা কিছুতে ঠাঁই হয়েছে এই শিল্পের।

তবে এসএ মালেকের মতে, দেশজুড়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক রিকশা পেইন্টার রয়েছেন। তার মতো যারা প্রচারের আলোয় এসেছেন, তারা টিকে আছেন। বাকিরা ধুঁকছেন।

কী চমৎকার দেখা গেল, খঞ্জনির তালে বাক্সের পাল্টে যাওয়া ছবির সাথে এমন বর্ণনায় মেলা মাতিয়ে রাখেন জলিল মণ্ডল। এক সময়কার গ্রাম বাংলার সিনেমা ছিল যে বায়োস্কোপ, তা দেখিয়ে এখন আর জলিল মণ্ডলের পেট চলে না। তাই মেলা বাদে বাকি সময় কৃষি কাজ করেন জলিল।

বলছেন, হল বন্ধ, টিভি বন্ধ। এখন বায়োস্কোপ দেখিয়ে কি পেটের ভাত হয়? তবু বাপ-দাদার পেশা। মনের আনন্দে দেখাই। এই শিল্পধারার টিকে থাকার উপায় কী? বায়োস্কোপওয়ালা জলিল মণ্ডলরা যে আনন্দে এখন মেলা থেকে মেলায় বায়োস্কোপ দেখিয়ে বেড়ান, সে আনন্দই শক্তি বলছেন শিল্পী ও নাট্য নির্দেশক মুস্তফা মনোয়ার।

তার মতে, পৃষ্ঠপোষকতা করে এই শিল্পকে বাঁচানো যাবে না। এটা হতে হবে সমাজের মধ্য থেকেই।

শিল্পী বলছেন, গ্রামে যে শিল্পকলা ছিল, তা ধর্ম বিচারে ছিল না। ধর্ম বিচারে ব্যবহার হতো না। গ্রামীণ সৌন্দর্যের সঙ্গে সরলতা মিশে তা হতো। কোনো বিশেষ কায়দা, কোনো বিশেষ রূপরেখা নেই, করে যাচ্ছে, হয়ে যাচ্ছে। এই যে আনন্দের সঙ্গে করছে, এবং হয়ে যাচ্ছে- এটাই শিল্পকলার বড় কথা। পট চিত্রের কথাই ধরো। পটে আঁকা ছবি তাদের মনের ছবি। যে পাখিটা তারা আঁকছে তা মনের পাখি। এবং এর রক্ষা সমাজে-জীবনে থাকে। ধর্মীয় বিষয় একটু এদিক-ওদিক হয়েছে। কিন্তু টিকে থাকাটা সমাজের ভেতর থেকেই আসতে হবে। লোক শিল্প স্বতঃস্ফূর্ত। এটিকে যখন পৃষ্ঠপোষকতা করবেন, তখন তা অভিজাত শিল্পের দিকে ধাবিত হবে, এমনই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন।

তার মতে, লোক শিল্প হচ্ছে আম জনতার রুচি অনুযায়ী আম জনতার প্রয়োজনে আম জনতার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আম জনতার পর্যায়ের মানুষের তৈরি শিল্প। আমাদের ট্র্যাডিশনাল আর্টে দেখেন, একজন শিল্পী তার অঞ্চলে সাধারণ মানুষের জন্য তার কাজগুলো করেন।

শম্ভূ আচার্যের পটচিত্রের উদাহরণ টেনে অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, তার বাবা সুধীর আচার্য ১৯২০-২১ সাল থেকে পটচিত্র করেছেন। এবং এই পটচিত্রগুলো বিক্রির জন্য ছিল না। বিক্রিও হতো না। পটচিত্রের গল্পটা কমিউনিকেট করে যেন আনন্দ দেয়, সে কারণেই পটুয়ারা পটগুলো নিয়ে আসতো। আমাদের দেশে এগুলো বেদেরা ঘুরে ঘুরে দেখাতো। এটা সরাসরি বিক্রি হতো না। বেদেরা যে মাধুকরী পেতো, তাই দিয়ে তারা পটুয়াদের কাছ থেকে নিতো।

সুধীর আচার্যরা জীবন নির্বাহ করতেন কুণ্ডলিসহ নানা কিছু করে। তারা পট আঁকতেন অনেকটাই মনের আনন্দে। কিন্তু ছেলে শম্ভূ আচার্যের কাছে তা আর সহজ, সরল রইলো না। তিনি অনেক সময় নিয়ে অনেক শিল্পীতভাবে আঁকেন। এবং তা ভালো দামে বিক্রিও হয়।

নিসার হোসেনের মতে, লোক শিল্প তার সংজ্ঞার মতোই চলবে নদীর মতো। কখনো শুকিয়ে যাবে। কখনো উপচে পড়া বন্যা হবে। এটা নিজে থেকে চলার শিল্প! ডয়েচে ভেলে